সমবায় সমিতি কি বা কাকে বলে ?
সমবায়ের শাব্দিক অর্থ হলো সম্মিলিত কর্মপ্রচেষ্টা বা সকলের মিলিত উদ্যোগে কোনো কিছু গড়ে তোলার প্রয়াস। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এগিয়ে যাওয়ার চিন্তা থেকেই মূলত সমবায় সংগঠনের উৎপত্তি। তাই নিজেদের অর্থনৈতিক কল্যাণ লাভের জন্য সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সমবায় আইনের আওতায় গড়ে তোলা সংগঠনকেই সমবায় সংগঠন বলে। তুলনামূলকভাবে কমবিত্তসম্পন্ন সমশ্রেণি বা পেশার মানুষ নিজেদের স্বার্থে সংঘবদ্ধ হয়ে সমঅধিকারের ভিত্তিতে সমবায় আইনের আওতায় এই ধরনের সংগঠন গড়ে তোলে।
“একতাই বল’ বা ‘ঐক্যই শক্তি’ এরূপ ব্যবসায়ের মূল শ্লোগান বা নীতিবাক্য । সকলের তরে সকলে, দশে মিলে করি কাজ, স্বাবলম্বনই শ্রেষ্ঠ অবলম্বন, সাম্য ও সহযোগিতা, সংখ্যাগরিষ্ঠের মতই সকলের মত ইত্যাদি মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে এই প্রতিষ্ঠান স্বকীয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে সকল সমাজেই বিরাজমান ।
সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এগিয়ে যাওয়ার ধারণা সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই লক্ষণীয় । একসাথে মিলে-মিশে পশু শিকার, মৎস্য শিকার- এভাবে নানান কাজ করেছে মানুষ । ব্যক্তিক সামর্থ্যকে অন্যের সাথে সমন্বয় করে ব্যবসায় গঠনের ধারণাও প্রাচীন । অংশীদারি ব্যবসায়ের উদ্ভবই এর প্রমাণ (গ্রীক ও রোমান সভ্যতাকালে শ্রমিক সংঘ (Workers Union), বণিক সংঘ (Merchant guild), কারিগরি সমবায় সংঘ (Craft guild) ইত্যাদি গঠনের পিছনেও এই প্রেরণাই কাজ করেছিল ।
সমবায় সমিতির ধারণা ও ইতিহাস
মধ্যযুগের শেষ পর্যায়ে অর্থাৎ ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে সমবায়কে প্রথমত একটা ধারণা ও পরবর্তীতে আন্দোলন হিসেবে গড়ে তোলার প্রয়াস লক্ষণীয়। এ সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পি.সি পকবয় (P. C. Plockboy) সমবায়কে একটা সামাজিক ধারণা হিসেবে উপস্থাপন করেন। বৃটেনে মিঃ ওয়েন (Owen) এর নেতৃত্বে এবং ফ্রান্সে মি. কিং (King) ও মি. বুচেজ (Buchez) এর নেতৃত্বে সমবায় একটা আন্দোলন হিসেবে চিন্তাগত উৎকর্ষতা লাভে সমর্থ হয় ।
১৭৫২ সালে প্রেসিডেন্ট বেঞ্জামিন ফ্রাংকলিন আনুষ্ঠানিকভাবে সমবায়কে প্রতিষ্ঠা করলেও আমেরিকান সমাজে কৃষকদের প্রয়োজনীয় কৃষি উপকরণ ও সরঞ্জাম সংগ্রহে প্রয়োজনীয় রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার বাইরে একে ব্যবসায় হিসেবে গড়ার চিন্তা কার্যকর হয়নি ।
অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝিতে শিল্প বিপ্লব (১৭৫০-১৮৫০) শুরু হওয়ার পর শিল্পাঞ্চলগুলোতে শ্রমিকদের ভিড় বাড়তে থাকে । কৃষি ছেড়ে চলে আসা এ সব শ্রমিক এক পর্যায়ে মারাত্মক বৈষম্যের শিকারে পরিণত হয়। তাদের অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে, প্রয়োজনীয় সামগ্রী কেনার সামর্থ্যও তারা হারিয়ে বসে। দোকান মালিকরা তাদের এই অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে বেশি মূল্যে বাকিতে পণ্য বেঁচে তাদেরকে সর্বশান্ত করে ফেলে ।
অনেক শিল্প মালিক শ্রমিকদের শ্রম বন্ধক রেখে অধিক মূল্যে পণ্য সরবরাহ করে নির্দয় আচরণ করে । শ্রমিকরা নিজেদের বেতন ও সুবিধা বৃদ্ধির জন্য আন্দোলন ও ধর্মঘট করলেও তা তাদের জীবনমান বৃদ্ধিতে ব্যর্থ হয় । এ অবস্থা থেকে রক্ষা পেতে ইংল্যান্ডের ল্যাংকশায়ারের ২৮জন বস্ত্রকল শ্রমিক (তাঁতি) ১ স্টার্লিং পাউন্ড করে জমা দিয়ে ।
তাঁরা ‘রচডেল সোসাইটি অব ইক্যুইটিবল পাইওনিয়ারস‘ নামে একটা সমিতি প্রতিষ্ঠা করে । এক্ষেত্রে তারা সমবায়ের কতকগুলো আদর্শ নির্দিষ্ট করে তা মেনে চলতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়। অতঃপর ১৮৪৪ সালের ২১ ডিসেম্বর তারা ছোট্ট একটা দোকান প্রতিষ্ঠা করে প্রথমত এখানে কিছু ময়দা, জবের আটা, মাখন, চিনি ও মোমবাতি জোগাড় করে ন্যায্যমূল্যে সদস্যদের মধ্যে সরবরাহের ব্যবস্থা করে ।
এতে একদিকে প্রয়োজনীয় সামগ্রী ন্যায্যমূল্যে পাওয়ায় তাদের যেমনি সুবিধা হয় তেমনি দোকান থেকে অর্জিত লাভ তাদের সামর্থ্য ও শক্তি বৃদ্ধি করে । ফলে অন্য শ্রমিকদের মধ্যেও আগ্রহের সৃষ্টি হয় । রচডেলের এই মডেল বৃটিশ সমাজে এতটা প্রভাব বিস্তার করে যে, মাত্র ১০ বছরের ব্যবধানে এখানে প্রায় এ ধরনের ১,০০০ সমবায় সমিতি গড়ে ওঠে ।
পরবর্তীতে এই মডেল বৃটেনের গণ্ডি পেরিয়ে প্রতিবেশী দেশসমূহেও জনপ্রিয়তা লাভ করে । এ সময়ে জার্মানিতে বাইফিজেন-এর নেতৃত্বে কৃষক সমবায় সমিতি, ফ্রান্সে চার্লস ফুরিয়ার-এর নেতৃত্বে উৎপাদক সমবায় সমিতি এবং ইতালিতে লুইনি লুজাস্টির নেতৃত্বে ঋণদান সমবায় সমিতি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় ।
জাপানসহ অন্যান্য দেশেও সমবায় বিস্তৃতি লাভে সমর্থ হয় । এরই প্রেক্ষাপটে ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে সমবায়ের মতাদর্শে ‘আন্তর্জাতিক সমবায় প্রতিষ্ঠান’ এর জন্ম লাভ ঘটে ।
ভারতীয় উপমহাদেশ শাসনকারী তৎকালীন বৃটিশ সরকার এ উপমহাদেশে কৃষকদের আর্থিক দুর্দশা থেকে রক্ষায় সমবায় প্রতিষ্ঠার বিষয় চিন্তা করে এবং এরই ধারাবাহিকতায় ১৯০৪ সালে সর্বপ্রথম উপমহাদেশে সমবায় আইন পাস হয় ।কলকাতায় বেঙ্গল কো অপারেটিভ ফেডারেশন ১৯১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ।
পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর এই ভুখন্ডে সমবায় আন্দোলন বিস্তৃতি পায় । (১৯৫৯ সালে প্রখ্যাত সিভিল সার্ভিস কর্মকর্তা ড. আকতার হামিদ খান-এর নেতৃত্বে কুমিল্লায় পাকিস্তান পল্লী উন্নয়ন একাডেমী (PARD) প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি কুমিল্লা সদর থানার বিভিন্ন এলাকার কৃষকদের নিয়ে ছোট ছোট সমবায় প্রতিষ্ঠা করে থানা কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতি (TCCA) ফেডারেশনের আওতায় তা সংঘবদ্ধ করেন।
পরবর্তীতে এই মডেল কুমিল্লা মডেল নামে পরিচিতি লাভ করে ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায় এবং সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে । স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় হলে এ প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হয় Bangladesh Academy of Rural Development (BARD) বাংলায় বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমী ।
২০১৬ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত হিসাব মতে, বাংলাদেশে নিবন্ধিত মোট সমবায় সমিতির সংখ্যা প্রায় ১,৭৮,৯৫৬টি। এর মধ্যে জাতীয় পর্যায়ের সমিতি ২২টি, কেন্দ্রীয় সমিতি ১,১৬৯টি এবং প্রাথমিক সমিতি ১,৭৭,৭৬৫টি।
মিল্ক ভিটা নামে দুগ্ধ বাজারজাতকারী বাংলাদেশ দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় ইউনিয়ন লি. বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য সমবায় সংগঠন হিসেবে পরিচিত । ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত জাতীয় সমবায় ব্যাংকও এদেশে একটা নামকরা সমবায় প্রতিষ্ঠান । বাংলাদেশের সমবায় সমিতিসমূহ বর্তমানে ২০০১ সালের সমবায় আইন ও ২০০৪ সালের সমবায় অধ্যাদেশ অনুযায়ী গঠিত ও পরিচালিত হয় ।
আরো পড়ুন ,,,
➡️যৌথ মূলধনী কোম্পানির মূলধন ধারণা ।
➡️প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানী কাকে বলে ?
➡️যেীথ মূলধনী ব্যবসা কাকে বলে ?
নিয়মিত এডুকেশন সম্পর্কিত তথ্য পেতে যুক্ত থাকুন আমাদের ফেইসবুক পেইজের সাথে ।