সমবায় সমিতির বৈশিষ্ট্য

সমবায় সমিতির বৈশিষ্ট্য : সমবায় একটি আইন সৃষ্ট, অনন্য বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ব্যবসায় সংগঠন । সাধারণ ব্যবসায় হতে এর পার্থক্য এমন যে, এম. এল. ডার্লিং বলেছেন, “এটি কোনো রীতি বা তন্ত্র অপেক্ষা কিছু বেশি, এটি হলো একটি শক্তি অথবা প্রাণ চাঞ্চল্যপূর্ণ হৃদয় ও মনের ভাবনা । এটি ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য একটি ধর্ম ।”

নিম্নে এরূপ সমবায় সমিতির বৈশিষ্ট্য সমূহ তুলে ধরা হলো :

১. গঠন প্রকৃতি (Nature of formation) : দেশে প্রচলিত সমবায় আইন অনুযায়ী কতিপয় ব্যক্তি স্বেচ্ছ সংঘবদ্ধ হয়ে এরূপ ব্যবসায় গঠন করে। এজন্য ফি প্রদানপূর্বক নির্দিষ্ট ফরমে সমবায় নিবন্ধকের নিকট আবেদন করতে হয় এবং অনুমোদন পাওয়ার পরই আইন অনুযায়ী এর কাজ শুরু করা যায় । 

বাংলাদেশে সমবায় সমিতি আইন ২০০১ এবং সমবায় সমিতি বিধিমালা ২০০৪ অনুযায়ী এ দেশের সমবায় সমিতিসমূহ গঠিত হয়।

 

২. উদ্দেশ্য (Objectives) : সমবায়ের মূল উদ্দেশ্য হলো এর সদস্যদের আর্থ-সামাজিক কল্যাণ নিশ্চিত করা । অন্য ব্যবসায়ের ন্যায় শুধুমাত্র মুনাফা অর্জন এর উদ্দেশ্য নয়। এলাকার কৃষকরা সমবায়ের মাধ্যমে গভীর নলকূপ বসিয়ে একত্রে চাষাবাদ করছে। এক্ষেত্রে অবশ্যই সেচের পানি সরবরাহের জন্য প্রত্যেক সমবায়ী সমবায় সমিতিকে অর্থ পরিশোধ করছে এবং এতে মুনাফা হওয়ারও সুযোগ রয়েছে। তবে বড় কথা হলো সমবায়ের মাধ্যমে গভীর নলকূপ বসায় তাদের ফসলের উৎপাদন বেড়েছে এবং এতে সবাই আর্থিকভাবে লাভবান হতে পেরেছে ।

 

৩. সদস্য সংখ্যা (Number of members) : ২০০১ সালের সমবায় সমিতি আইনের ৮ ধারা অনুযায়ী। প্রাথমিক সমবায় সমিতি গঠন করতে হলে কমপক্ষে ২০ (কুড়ি) জন ব্যক্তি সদস্য এবং কেন্দ্রীয় ও জাতীয় সমবায় সমিতিতে ১০(দশ) জন প্রাতিষ্ঠানিক সদস্য থাকতে হয় । সদস্য সংখ্যার সর্বোচ্চ সীমা আইনে বলা হয়নি । ৪. সদস্যদের প্রকৃতি (Nature of members) : এটি তুলনামূলকভাবে সমাজের কম বিত্তসম্পন্ন মানুষদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গঠিত সংগঠন ।

সাধারণত দরিদ্র কৃষক, তাঁতী, জেলে, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, স্বল্প শিক্ষিত যুবক, মহিলা ইত্যাদি শ্রেণির লোকেরাই অধিক হারে সমবায় গঠন ও সমবায়ের সদস্যপদ গ্রহণ করে । যে কারণে একে Citadel of the exploited বা ‘শোষিতদের আত্মরক্ষার দুর্গ’ হিসেবে গণ্য করা হয় । অবশ্য মার্কেট সমবায় সমিতি, বাড়ি মালিক সমবায় সমিতি ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানে মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্তসম্পন্ন ব্যক্তিগণও নিজেদের কল্যাণের জন্য সমবায় সমিতি গঠন করে থাকে ।

 

৫. মূলধন সংগ্রহ (Collection of capital) : এরূপ প্রতিষ্ঠানের মূলধন স্বল্প অথচ সমমূল্যের কতকগুলো শেয়ারে বিভক্ত হয় । এরূপ শেয়ারের পরিমাণ ও প্রতি শেয়ারের মূল্য এর উপবিধিতে উল্লেখ থাকে । এই শেয়ার বিক্রয় ও সঞ্চয় আমানত সংগ্রহ করে এর মূলধন সংগ্রহ করা হয় ।

 

৬. শেয়ার ক্রয়ের সীমা (Limit of share purchase) : সমবায়ের অভ্যন্তরে সমবায়ীদের মধ্যে যেন অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টি না হয় এবং কেউ একে কুক্ষিগত করতে না পারে সেজন্য এক্ষেত্রে অবাধে শেয়ার ক্রয়ের সুযোগ দেয়া হয় না । আইনে বর্ণিত ব্যতিক্রমী ক্ষেত্র ব্যতিরেকে এর কোনো একক সদস্য এর শেয়ার মূলধনের সর্বোচ্চ এক-পঞ্চমাংশ (২০%)-এর অধিক মূল্যের শেয়ার ক্রয় করতে পারে না । 

 

৭. মুনাফা বণ্টন (Distribution of profit) : সমবায়ের অর্জিত মুনাফার সবটুকু সদস্যদের মধ্যে বণ্টিত হয় না । বাধ্যতামূলকভাবে এর ন্যূনতম ১৫% সংরক্ষিত তহবিলে এবং ৩% সমবায় উন্নয়ন তহবিল (যার ২% সমবায় প্রশিক্ষণ ও উদ্বুদ্ধকরণের জন্য ব্যয়যোগ্য) এর চাঁদা হিসেবে সংরক্ষণ করতে হয়। অবশ্য সমবায়ের উপবিধিতে উল্লেখ থাকলে অন্যান্য উদ্দেশ্যে অর্জিত মুনাফার সর্বাধিক ১০% সংরক্ষণ করা যায় । অবশ্য অর্থায়নকারী বা ঋণদানকারী সমবায় সমিতির বেলায় কু ঋণ সঞ্চিতি হিসাবে মুনাফার ১০% বাধ্যতামূলকভাবে সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে। 

বাকি অংশ সাধারণ সভার সিদ্ধান্তক্রমে শেয়ারগ্রহীতাদের মধ্যে বণ্টন করা হয়। উল্লেখ্য, সংরক্ষিত তহবিলে জমার সর্বোচ্চ ৫০% সমিতির ব্যবসায়িক কার্যক্রমে বিনিয়োগ করা যেতে পারে । 

 

৮. ব্যবস্থাপনা কমিটি (Managing committee) : সমবায়ীদের মধ্য থেকে সমবায় পরিচালনার জন্য নির্বাচিত ব্যক্তিবর্গের সমষ্টিকে ব্যবস্থাপনা কমিটি বলে । ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব অত্র আইন, বিধি ও উপবিধি মোতাবেক গঠিত কমপক্ষে ৬ ও সর্বোচ্চ ১২ জন সদস্য সম্বলিত (যা তিন দ্বারা বিভাজ্য) ব্যবস্থাপনা কমিটির ওপর ন্যস্ত থাকে । প্রথম ব্যবস্থাপনা কমিটির মেয়াদ ১(এক) বছর এবং এরপর থেকে এ মেয়াদ ৩(তিন) বছর হয় । 

 

৯. সম-ভোটাধিকার (Equal voting right): সমবায়ের প্রত্যেক সদস্যের শেয়ার মূলধন বা জমার পরিমাণ যা-ই হোক না কোন একক ভোটের অধিকারী । তাই সদস্যদের সম-ভোটাধিকার এর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য । সমবায়ে সফলতার চাবিকাঠি হলো সমবায়ীদের ঐক্য । এই ঐক্য বজায় রাখতে সমবায়ে সাম্যতার নীতি অনুসরণ করা হয় । অর্থাৎ সদস্যদের সামাজিক, ধর্মীয় ও বংশ পরিচয়, অর্থ ও বিত্ত যে ধরনেরই হোক সমবায়ে সবাই সমান । সম-ভোটাধিকারের মাধ্যমে এই সাম্যতাকে বাস্তবে লালন করা হয় ।

 

১০. সদস্যদের দায় (Liability of members) : সাধারণত সমবায় সমিতিতে এর প্রত্যেক সদস্যের দায় তার ক্রয়কৃত শেয়ার মূল্য দ্বারা সীমাবদ্ধ থাকে । অর্থাৎ এর অতিরিক্ত দায় বহনে তাকে বাধ্য করা যায় না । এ কারণেই এর নামের সাথে সীমিত Ltd. শব্দের উল্লেখ করতে হয় । অবশ্য সীমাহীন দায়সম্পন্ন সমিতিও গঠন করা যায় ।

 

১১. সরকারি নিয়ন্ত্রণ ও পৃষ্ঠপোষকতা (Government control and assistance) : সমবায় আইনসৃষ্ট প্রতিষ্ঠান বিধায় এর ওপর স্বভাবতই সরকারি নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকে । এ ছাড়াও সমবায়ের উন্নতির জন্য সরকার এর সভা অনুষ্ঠান, কমিটি গঠন, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, পরিচালনা, হিসাবপত্র রক্ষণ ইত্যাদি বিষয় তত্ত্বাবধান করে । এর বাইরেও সরকার নিজ দায়িত্বে সমবায়ীদের প্রশিক্ষণ দান ও বিভিন্ন আর্থিক-অনার্থিক সহযোগিতা প্রদান করে । 

উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যাবলি বিশ্লেষণ করলে পরিশেষে বলা যায়, সমবায় সমিতি আইনের অধীনে নিবন্ধিত, পৃথক সত্তা ও সীমিত দায়বিশিষ্ট একটি স্বেচ্ছাপ্রণোদিত ব্যবসায় সংগঠন যা এর সদস্যদের দ্বারা গণতান্ত্রিক রীতি-নীতি অনুসরণে পরিচালিত হয় । যার মূল লক্ষ্য হলো এর সদস্যদের আর্থ-সামাজিক কল্যাণ নিশ্চিত করা ।

 

তথ্য সূত্র : বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০১৭

 

আরো পড়ুন ,,,

➡️সমবায় সমিতি কি বা কাকে বলে ?

➡️যৌথ মূলধনী কোম্পানির বৈশিষ্ট্য ।

➡️যেীথ মূলধনী ব্যবসা কাকে বলে ?

নিয়মিত এডুকেশন সম্পর্কিত তথ্য পেতে যুক্ত থাকুন আমাদের ফেইসবুক পেইজের সাথে ।

By MD Imran hossan

২০১৯ সাল থেকে যুক্ত আছি এই টেকনোলজির দুনিয়ার সাথে । যদিও আমার পড়াশোনা ব্যবসা ও বাণিজ্য নিয়ে । ওয়েবসাইট ডেভেলপ করে দেওয়ার পাশাপাশি বর্তমানে লিখালিখি ও ব্লগিং সেক্টর এর সাথে যুক্ত আছি । নিজের জ্ঞান কে অন্যদের সাথে ভাগাভাগি করে নেওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠা করেছি Goafta.com ওয়েবসাইট । স্বপ্ন দেখছি একটি বিশ্বস্ত ব্যবসায়িক ব্লগ গড়ে তোলার । এবং নিজে যতটুকু জানি তা সবার কাছে ছড়িয়ে দেওয়ার , তাতে যদি কারো শস্য পরিমাণও উপকার হয় তাতেই আমার প্রশান্তি |

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *