শ্রমের মর্যাদা রচনা

শ্রমের মর্যাদা রচনা

সূচনা : ইংরেজিতে একটি কথা আছে– Industry is the key to success. পরিশ্রম সৌভাগ্যের চাবিকাঠি। আমাদের চতুর্দিকে দৃষ্টিপাত করলেই কর্মের বিপুল দৃশ্য চোখে পড়ে। জীব-জগৎ থেকে শুরু করে গ্রহ-নক্ষত্রের জগৎ সর্বত্রই কেবল কাজ আর কাজ। আকাশে চন্দ্র-সূর্য-তারকা প্রতিদিন আপন আপন নির্দিষ্ট কর্ম সাধন করে চলেছে। 

অন্যদিকে প্রাণীলোকের ক্ষুদ্রতম কীট থেকে বৃহত্তম জীব পর্যন্ত সকলেই কোনো না কোনো কাজে লিপ্ত রয়েছে। আসলে প্রাকৃতিক শাসনেই সবাইকে কর্মব্যস্ত থাকতে হয়। মানুষের পক্ষে এ কথা আরও বেশি করে সত্য। কারণ জীব-জগতে মানুষের মতো বিপুল চাহিদা আর কারো নেই। তাই তার কাজেরও অন্ত নেই ।

শ্রমের গুরুত্বঃ আমরা সবাই এ কথা ভালো করেই জানি যে, পরিশ্রম ছাড়া পৃথিবীতে কোনো কিছুই সম্ভব নয়। সমস্ত কর্মই শ্রমসাপেক্ষ। আমরা আমাদের নিত্য দিনের অভিজ্ঞতা থেকেই একথা বুঝতে পারি। আমাদের ক্ষুধা-তৃষ্ণা আছে। তা নিবারণের জন্য খাদ্য সংগ্রহ করতে হয়। আবার সে জন্য অর্থ উপার্জনেরও প্রয়োজন পড়ে। 

অর্থ উপার্জনের সামর্থ্য অর্জনের জন্য মানুষকে আবার বিদ্যা শিক্ষা বা আরও বহু রকমের শিক্ষা লাভ করতে হয়। এভাবে দেখা যায় যে, পরিশ্রম ছাড়া জগতে নিজের অস্তিত্ব কোনো রকমেই টিকিয়ে রাখা যায় না। তাছাড়া মানুষের জীবন তো কেবল ক্ষুধা-তৃষ্ণার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, তার আরও যে কত কিছুর প্রয়োজন তা বলে শেষ করা যায় না। আবার সেই অসংখ্য প্রয়োজন মেটাতে মানুষকে সুদূর আকাশ থেকে সমুদ্রের গভীর তল পর্যন্ত রাতদিন ছোটাছুটি করে বেড়াতে হচ্ছে।

 বিনা শ্রমে জীবনের প্রয়োজন পূরণের কোনো প্রশ্নই আসে না। বস্তুত শ্রমই মানুষের সমস্ত সৌভাগ্যের মূল। মানুষের সমস্ত কীর্তির মূলে রয়েছে এই শ্রম। জ্ঞানীর জ্ঞান, সাধকের উপলব্ধি, বিজ্ঞানীর আবিষ্কার, ধনীর ধন সবকিছুই শ্রমলব্ধ জিনিস। সুতরাং শ্রমের মর্যাদা যে কত অপরিসীম তা একটু চিন্তা করলেই উপলব্ধি করা যায়।

জাতীয় উন্নতিতে শ্রমের গুরুত্বঃ আমাদের জীবনে পরিশ্রমের গুরুত্ব অপরিসীম। কর্মবিমুখ জাতি কোনদিনই উন্নতি লাভ করতে পারে না। এই বৈচিত্র্যময় পৃথিবীতে যত বৈচিত্র্যপূর্ণ কাজই থাকুক না কেন সর্বক্ষেত্রেই সাফল্য অর্জনের জন্য পরিশ্রমের যথেষ্ট প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। শ্রম বিমুখ জাতি কখনো আত্মনির্ভরশীল হতে পারে না। 

যে পরিশ্রমের ফলে মানুষের জীবন সার্থকতায় মন্ডিত হয়ে ওঠে তার যথাযোগ্য মর্যাদা আমাদের দিতে হবে। যুগে যুগে নিজের শ্রমের বিনিময়ে জীবনের গৌরব বৃদ্ধি করতে মানুষ সক্ষম হয়েছে। মানুষের শ্রেষ্ঠ বন্ধু হল তার হাতের দশটি আঙ্গুল। এরই সাহায্যে সে কর্মমুখর হয়ে ওঠে।

ব্যক্তিগত ও জাতিগত জীবনে উন্নতি সাধন করতে হলে শ্রমের মর্যাদা স্বীকার করতে হবে। কোনো মানুষই কঠিন পরিশ্রম ছাড়া যথার্থ সাফল্য অর্জন করতে পারে না। ব্যক্তিগত দিকটি ছাড়াও জাতীয় জীবনে যথার্থ সাফল্য ও উন্নতির জন্য কঠোর পরিশ্রমের প্রয়োজন।

 জীবনের সর্বক্ষেত্রে শ্রমের অপরিসীম প্রয়োজনীয়তা বর্তমান থাকলেও পৃথিবীতে বারবার শ্রমকে অবহেলা করা হয়েছে। তার উপযুক্ত মর্যাদা দেয়া হয়নি। বিশেষত আমাদের দেশে শ্রমের প্রকৃত মর্যাদা দেয়া হয় না। শ্রমজীবীদের প্রতি তথাকথিত ভদ্রলোকের একটি অবজ্ঞার ভাব সর্বদা বিরাজ করে। যে কৃষক সমগ্র দেশের অন্নের যোগান দেয় সে ‘চাষা’ হিসেবে অবজ্ঞার পাত্র হয়ে আছে আমাদের কাছে। 

এ উন্নাসিকতা আমাদেরকে হীন ও অনগ্রসর করেছে। প্রকৃত ভাবে দেশকে উন্নত করতে হলে শ্রমজীবী মানুষকে মূল্যায়ন করতে হবে। চাষী, শ্রমিক, তাঁতী, মালি এরাই আমাদের অর্থনীতির মূল মেরুদণ্ড। এদের শ্রমকে গুরুত্বসহ বিবেচনা করতে পারলেই জাতির সত্যিকার উন্নতি সাধিত হবে।

শ্রম সম্পর্কে আমাদের ধারণা : আমাদের দেশে শ্রমের মর্যাদা তেমন নেই। বিশেষ করে কায়িক শ্রমকে অনেকেই অবজ্ঞার চোখে দেখে। এই শ্রেণীর মানুষের ধারণা, কায়িক শ্রম মানুষের সম্মানের জন্য হানিকর। এই ঠুনকো সম্মানবোধের জন্যই আমাদের অনেক দুর্ভাগ্য বরণ করে নিতে হয়েছে। এ জাতীয় মনোভাব পোষণ করে থাকেন আমাদের শিক্ষিত ও তথাকথিত অভিজাত লোকেরা।

 অথচ শিক্ষার আলোকে আলোকিত হয়ে তাদেরই শ্রমের মর্যাদা সম্পর্কে সচেতন হওয়া সবচেয়ে বেশি দরকার। নিজের কাজ নিজে করার মধ্যে কোনো অগৌরব নেই, তাতে বরং সম্মান বৃদ্ধি পায়। তাছাড়া স্বাস্থ্যগত কারণে মানুষের কায়িক শ্রম করা প্রয়োজন। কিন্তু তা না করে আমাদের শিক্ষিত লোকেরা কলম পেশাকেই একমাত্র সম্মানের কাজ বলে মনে করেন। 

এ মনোভাব একটি জাতির জন্য ক্ষতিকর। কায়িক শ্রম কেবল অশিক্ষিত মূর্খ লোকদের জন্য আর শিক্ষিত লোকদের জীবন কেবলই আরাম-আয়েশের জন্য এ মানসিকতা জাতীয় উন্নতির ক্ষেত্রে বিরাট অন্তরায়।

শ্রম সম্পর্কে উন্নত বিশ্বের মনোভাবঃ পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালে আমরা এক ভিন্ন চিত্র লক্ষ্য করি। এসব দেশের অধিবাসীরা শ্রমকে অসামান্য মর্যাদা দিয়ে থাকে। শ্রমের বলেই তাদের যাবতীয় উন্নতি সম্ভব হয়েছে। ইংল্যান্ড, আমেরিকা, ফ্রান্স, জাপান প্রভৃতি দেশ এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এসব দেশের মানুষ আলস্যে একটু সময়ও অযথা নষ্ট করে না।

 তাদের জীবনযাত্রার দিকে তাকালে দেখা যায় তারা কর্মব্যস্ত হয়ে অবিরাম ছোটাছুটি করছে। রাস্তাঘাটের দিকে তাকালেই তাদের এই কর্মচাঞ্চল্যের পরিচয় পাওয়া যায়। কাজকে তারা কাজ বলেই জানে। এজন্য কোনো ন্যায় কাজকেই তারা ছোট বলে মনে করে না। মুচি, কুলি, গৃহভৃত্য প্রভৃতি কাউকেই তারা ঘৃণা করে না। হাসি মুখে গৌরবের সঙ্গে তারা সব রকমের কাজ করে চলেছে। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র দোকানে সেলসম্যানের কাজ বা কুলির কাজ করতে কোনো দ্বিধা করে না। উচ্চপদস্থ ব্যক্তিরা গৃহে ফিরে সংসারের ছোটখাটো তুচ্ছ কাজ করতেও কোনো অগৌরব বোধ করেন না। এই মহৎ গুণের জন্যই যে তারা উন্নত জাতিতে পরিণত হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই ।

সভ্যতার মূলেই শ্রমঃ মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআন শরীফে বলা হয়েছে—“কোনো ব্যক্তি বা জাতি যতক্ষণ নিজের উন্নতির জন্য চেষ্টা না করে ততক্ষণ আল্লাহ তার সহায় হন না।” এই উক্তি প্রমাণ করে যে ব্যক্তি বা জাতির উন্নতি মানুষের কর্মের উপরই নির্ভরশীল। ভাগ্যের উপর নির্ভর করে নিষ্কর্মা হয়ে বসে থাকলে কারো মুখেই আহার জুটবে না।

 মানুষ বহু পূর্বে এই সত্য উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিল বলেই আজকের পৃথিবীতে মানুষের প্রগতি ও সভ্যতার এত সমৃদ্ধি, এত ঐশ্বর্য। আমাদের মনে রাখতে হবে মানুষের মধ্যে অনন্ত সম্ভাবনা নিহিত আছে। কিন্তু সেই সম্ভাবনা রয়েছে সুপ্ত অবস্থায়। তাকে বিকশিত করে তুলতে হলে সবার আগে যা প্রয়োজন তার নাম শ্রম ।

 

উপসংহার : আমাদের একথা সর্বদা স্মরণ রাখতে হবে যে, ব্যক্তিগত ও জাতীয় উন্নতির জন্য কঠোর পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নেই। তা না হলে কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য কোনদিক দিয়েই উন্নতি সম্ভব নয়। পুঁথিগত বিদ্যা অর্জন করার জন্য যে শ্রম ব্যয় করতে হয়, তা মূলত মানসিক।

 তাতে জ্ঞান বৃদ্ধি হলেও সব রকমের উন্নতির পথ সুগম হয় না। প্রকৃতির বুক থেকে সম্পদ আহরণ করতে গেলে কায়িক শ্রমেরই প্রয়োজন বেশি। অথচ এই সত্যকে ভুলে গিয়ে ঠুনকো সম্মানবোধ নিয়ে আমরা মত্ত হয়ে আছি। তাই শ্রমের মর্যাদা দিতে আমরা কুণ্ঠিত হই। কায়িক শ্রম যারা করে, তাদেরই গায়ের ঘাম ঝরে ঝরে সভ্যতার সৌধ গড়ে উঠেছে।

 আমরা পুরোমাত্রায় তার সুফল ভোগ করলেও তাদের শ্রমকে মর্যাদা দিতে শিখিনি। জাতি হিসেবে মানুষের মতো বাঁচতে হলে মন থেকে সব রকমের হীনমন্যতাবোধ বিসর্জন দিয়ে শ্রমের মর্যাদা সম্পর্কে আমাদের সচেতন হতে হবে। এই শ্রম সচেতনতার মধ্যেই নিহিত রয়েছে দরিদ্র বাংলাদেশের উন্নতির চাবিকাঠি।

 

আরো পড়ুন :

➡️মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ রচনা ।

➡️ একে ফজলুল হক রচনা ।

➡️বাংলাদেশের ফুল রচনা ।

➡️কাগজ রচনা ।

➡️বঙ্গবন্ধুর জীবনী বাংলা রচনা

➡️ বেগম রোকেয়া রচনা ।

নিয়মিত এডুকেশন সম্পর্কিত তথ্য পেতে যুক্ত থাকুন আমাদের ফেইসবুক পেইজের সাথে ।

 

By Saifur Rahman Arif

আমি মোহাম্মাদ সাইফুর রহমান আরিফ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ব্যবস্থাপনা বিভাগের ছাত্র । ব্যবস্থাপনার একজন ছাত্র হলেও বর্তমানে কিছুদিন যাবৎ আমি অনলাইনে লিখালিখি কাজের সাথে যুক্ত রয়েছি । এবং Goafta.com সাইটটির একজন আর্টিকেল রাইটার হিসাবে কাজ করছি ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *