যৌথ মূলধনী ব্যবসায় কাকে বলে ?
একটি যৌথ মূলধনী ব্যবসা, যা একটি যৌথ স্টক কোম্পানি নামেও পরিচিত, এটি হল এক ধরনের ব্যবসায়িক সত্তা যেখানে মালিকানা স্টকের শেয়ারে বিভক্ত। এই শেয়ারগুলি খোলা বাজারে কেনা এবং বিক্রি করা যেতে পারে এবং শেয়ারহোল্ডাররা কোম্পানির লাভ এবং সম্পদের একটি অংশের অধিকারী। এই ধরনের ব্যবসা একক মালিকানা বা অংশীদারিত্ব থেকে আলাদা । যৌথ স্টক কোম্পানিগুলিকে স্টক এক্সচেঞ্জে প্রকাশ্যে লেনদেন করা যেতে পারে, বা ব্যক্তিগতভাবে অনুষ্ঠিত হতে পারে।
যৌথ মূলধনী ব্যবসা ইতিহাস
১৭৫০ সাল থেকে ১৮৫০ সাল অব্দি ইউরোপের শিল্প জগতে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয় তাই ইতিহাসে শিল্প বিপ্লব নামে পরিচিত । এতে উৎপাদন ব্যবস্থা পরিবার থেকে বেরিয়ে শিল্প কারখানায় স্থানান্তরিত হয় । বড় বড় শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে ।
এই ধরনের ব্যবসা গঠন ও পরিচালনায় এক মালিকানা ও অংশীদারি ব্যবসায় সংগঠন কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়ে । নানান চেষ্টা-প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে জন্ম নেয় নতুন ব্যবসা সংগঠন যৌথ মূলধনী ব্যবসা বা কোম্পানি সংগঠন ।
এটি আইন-সৃষ্ট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দেশের প্রচলিত কোম্পানি আইন অনুযায়ী নিবন্ধন নিয়ে অথবা সরকারের বিশেষ অধ্যাদেশ বলে এইরূপ প্রতিষ্ঠান গঠিত ও পরিচালিত হয় । নিবন্ধিত কোম্পানি সংগঠনে হাজার-হাজার শেয়ার মালিক থাকতে পারে । তাই এর পরিচালন ব্যবস্থা অন্যান্য ব্যবসা থেকে পৃথক ।
যৌথ মূলধনী কোম্পানির সুবিধা ও অসুবিধা
➡️কোম্পানি সংগঠনের সুবিধা – Advantages of Company Organization
বর্তমান বৃহদায়তন ব্যবসায় জগতে কোম্পানি সংগঠন সবচেয়ে উত্তম ব্যবসায় সংগঠন হিসেবে সকল দেশেই সমাদৃত । এরূপ ব্যবসায়ের যে সকল সুবিধা লক্ষণীয় তা নিম্নে আলোচনা করা হলো :
১. অধিক মূলধন (Adequacy of capital) : সদস্য সংখ্যা বেশি হওয়ার সুযোগে এবং পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে শেয়ার ও ঋণপত্র বিক্রয়ের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহের সুযোগ থাকায় এক্ষেত্রে সহজেই অধিক মূলধন সংগ্রহ করা যায়। ফলে এ ধরনের ব্যবসায়ের সম্প্রসারণ অনেক সহজ ।
২. সীমিত দায় (Limited liability) : এরূপ ব্যবসায়ে শেয়ারহোল্ডারদের দায় সাধারণত ক্রয়কৃত শেয়ারের আঙ্কিক মূল্য (Face value) দ্বারা সীমাবদ্ধ থাকে। ফলে শেয়ারমালিকগণ নিশ্চিন্তে এর শেয়ার ক্রয় করতে পারে । এ ছাড়া শেয়ারমালিকের সংখ্যা অনেক বেশি থাকায় প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি হলে তার ঝুঁকি অনেকের মধ্যে বণ্টিত হয় ।
৩. চিরন্তন অস্তিত্ব (Perpetual succession) : কোম্পানির পৃথক আইনগত সত্তা একে চিরন্তন অস্তিত্বের মানে উন্নীত করেছে। ফলে কোনো শেয়ার মালিকের মৃত্যু, দেউলিয়াত্ব বা অন্য কোনো কারণে এর অস্তিত্ব সহজে বিপন্ন হয় না । ফলে এ ব্যবসায়ের ওপর জনগণের আস্থা অনেক বেশি থাকে ।
৪. স্বাধীন সত্তা (Separate entity) : আইনগতভাবে এ ব্যবসায় স্বাধীন কৃত্রিম ব্যক্তিসত্তার মর্যাদা ভোগ করে । যার কারণে এ ব্যবসায় সংগঠন নিজস্ব নাম ও সীলমোহর ব্যবহার করে তৃতীয় পক্ষের সাথে যেকোনো চুক্তি বা লেনদেন সম্পাদন করতে পারে ।
৫. শেয়ারের হস্তান্তরযোগ্যতা (Transferability of share) : এ ব্যবসায়ের বিশেষত পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির শেয়ার অবাধে হস্তান্তরযোগ্য। ফলে কেউ ইচ্ছে করলেই শেয়াররাজার হতে সহজেই এর
শেয়ার ক্রয় ও প্রয়োজনে তা বিক্রয় করতে পারে।
৬. বৃহদায়তন ব্যবসায়ের সুবিধা (Advantages of large scale business) : এরূপ ব্যবসায় বৃহদায়তন প্রকৃতিতে গড়ে ওঠার কারণে বৃহদায়তন ব্যবসায়ের সুবিধা; যেমন- একসাথে অধিক পরিমাণে পণ্য ক্রয় ও বিক্রয়, কম খরচে পণ্য উৎপাদন, সুদক্ষ কর্মচারী নিয়োগ, বিভিন্ন ক্ষেত্রে মিতব্যয়িতা অর্জন ইত্যাদি সুবিধা ভোগ করে ।
৭. সুদক্ষ পরিচালনা (Efficient administration) : এ ব্যবসায়ের পরিচালনার ভার পরিচালনা বোর্ডের ওপর ন্যস্ত থাকে। পরিচালকগণ যোগ্যতার ভিত্তিতেই শেয়ারহোল্ডারগণ কর্তৃক নির্বাচিত হন। অপরপক্ষে আর্থিক সঙ্গতি থাকায় যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যবস্থাপকদের এক্ষেত্রে নিয়োগ করা যায় । ফলে এর ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত দক্ষ হয়।
৮. আকর্ষণীয় বিনিয়োগ ক্ষেত্র (Fields of lucrative investment) : চিরন্তন অস্তিত্ব, সীমিত দায়, আইনানুগ নিয়ন্ত্রণ, স্বল্পমূল্যে শেয়ার ক্রয়ের সুযোগ ইত্যাদি কারণে বিনিয়োগকারীদের নিকট এটা অত্যন্ত আকর্ষণীয় বিনিয়োগ ক্ষেত্র বিবেচিত হয়। এ ছাড়া শেয়ারমূল্য বাড়ার সুযোগ থাকায়ও বিনিয়োগকারীরা অধিক আকর্ষিত হয়ে থাকে ।
৯. ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ সামর্থ্য (Capacity of risky investment) : কোম্পানির শেয়ার মালিক ও পরিচালকবর্গের দায়-দায়িত্ব সীমিত হওয়ার কারণে এবং ঝুঁকি বণ্টনের সুযোগ থাকায় এরূপ সংগঠনের পরিচালকগণ সহজেই ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগে অংশ নিতে পারে। যা অনেক ক্ষেত্রেই ব্যবসায়ের জন্য লাভজনক বিবেচিত হয় ।
১০. ব্যাপক প্রচার (Well publicity) : শেয়ার মালিকদের সংখ্যা অনেক বেশি হওয়ার কারণে প্রত্যেক শেয়ারমালিক এর প্রচারে সাধ্যানুযায়ী ভূমিকা রাখে। এ ছাড়া বিবরণপত্র প্রচার, বিভিন্ন সভা আহ্বান, তথ্য পরিবেশন ইত্যাদি প্রয়োজনে প্রদত্ত বিজ্ঞাপনেও আপনা-আপনি প্রতিষ্ঠানের প্রচার সুবিধা পাওয়া
যায় ।
➡️কোম্পানি সংগঠনের অসুবিধা – Disadvantages of Company Organization
কোম্পানি সংগঠন বা যৌথমূলধনী ব্যবসায়ের অনেকগুলো সুবিধা থাকলেও বিভিন্ন দিক বিচারে এর বেশ ন অসুবিধাও দৃষ্ট হয় । যা নিম্নে আলোচিত হলো :
১. জটিল গঠন প্রণালী (Complexity of formation) : কোম্পানি সংগঠন একটি আইনসৃষ্ট ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান । যে কারণে এর গঠন বেশ সময়সাপেক্ষ, আনুষ্ঠানিকতাপূর্ণ ও ব্যয়বহুল । যার ফলে অনেকেই এরূপ ব্যবসায় গঠনে নিরুৎসাহ বোধ করে ।
২. পরিচালকদের স্বার্থসিদ্ধি (Undue interest of the directors) : পরিচালকগণ শেয়ারহোল্ডারদের পক্ষে সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার কারণে অনেক সময় তারা সম্মিলিতভাবে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের চেষ্টা চালায় । ফলে ব্যবসায় ও শেয়ারমালিকগণ ক্ষতিগ্রস্ত হয় ।
৩. আমলাতান্ত্রিকতা (Bureaucracy) : পরিচালকগণ ব্যবসায়ের পক্ষে পরিকল্পনা গ্রহণ, নীতি নির্ধারণ ও বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিলেও তা বাস্তবায়ন করে বেতনভুক তৃতীয় পক্ষ। যার কারণে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নে ধীর গতি পরিলক্ষিত হয়। ফলশ্রুতিতে ব্যবস্থাপনা আমলাতান্ত্রিকতার দোষে দুষ্ট হয়ে পড়ে ।
৪. স্বজনপ্রীতি (Nepotism) : কোম্পানির বিভিন্ন পদে লোক নিয়োগ, পদোন্নতি, পদচ্যুতি ইত্যাদি কাজ সম্পাদনের দায়িত্ব পরিচালকমণ্ডলীর ওপর ন্যস্ত থাকে। ফলে এ সকল বিষয়ে পরিচালকগণ অনেক সময় স্বজনপ্রীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার আশ্রয় গ্রহণ করে । এতে ব্যবসায় অদক্ষ হয়ে পড়ে ।
৫. পরিচালনা ব্যয়ের আধিক্য (Heavy administrative expenses) : এ ব্যবসায়ে বিভিন্ন সভা অনুষ্ঠান, অনুষ্ঠানাদি পালন, দলিল ও খাতাপত্র সংরক্ষণ, হিসাব নিরীক্ষা ইত্যাদি কার্যে যথেষ্ট উপরিখরচ হয় । ফলে অনেক ক্ষেত্রেই মুনাফার পরিমাণ হ্রাস পায় ।
৬. ক্ষমতা ও দারের মধ্যে অসঙ্গতি (Mal-adjustment between authority and liability) : পরিচালকগণ শেয়ারহোল্ডারদের পক্ষে সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী হলেও তাদের দায়-দায়িত্ব অনেকাংশে অন্যান্য শেয়ারহোল্ডারদের মতো। পরিচালক হিসেবে ক্ষেত্রবিশেষে দায়ের সৃষ্টি হলেও ক্ষমতার তুলনায় তা একান্তই কম । এরূপ অসঙ্গতি তাই অনেক ক্ষেত্রেই সমস্যার সৃষ্টি করে ।
৭. শেয়ার মালিকদের উপেক্ষা (Negligence shown to shareholders) : শেয়ারহোল্ডারগণ সম্মিলিতভাবে সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী বিবেচিত হলেও কার্যত পরিচালকগণ নিজেদের স্বার্থেই শেয়ার মালিকদের এরূপ ভূমিকা গ্রহণ বাধাগ্রস্ত করে। ফলে শেয়ারহোল্ডারগণ পরিচালকদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন ও উপেক্ষিত হন ।
৮. আইনের কড়াকড়ি (Strict observance of law) : এরূপ কোম্পানি গঠন হতে শুরু করে বিলোপ পর্যন্ত সকল ক্ষেত্রেই আইনের কড়াকড়ি অনুসরণ করতে হয় । যার ফলে ভালো উদ্যোক্তাদের উৎসাহ-আগ্রহও অনেকক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত হয় ।
অবশ্য প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির ক্ষেত্রে এ কড়াকড়ি কিছুটা কম । ৯. গোপনীয়তা প্রকাশ (Disclosure of secrecy) : শেয়ারমালিকদের সংখ্যাধিক্য, বার্ষিক সাধারণ সভায় সকল হিসাবপত্রাদি পেশ, নিবন্ধকের নিকট হিসাবপত্রাদি জমাদান ইত্যাদি অনেক আইনগত কারণেই এতে গোপনীয়তা রক্ষা করা যায় না । ফলে অনেক সময় ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় ।
পরিশেষে বলা যায়, যদিও এ ব্যবসায়ের অনেকগুলো অসুবিধা বা সীমাবদ্ধতা রয়েছে তথাপিও তুলনামূলক বিচারে এর সুবিধাটাই অনেক বেশি। সতর্কতার সাথে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে এর অনেকগুলো সীমাবদ্ধতাই দূর করা সম্ভব । তাই সকল দেশেই এটি একটি অপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্যবসায় সংগঠন হিসেবে ইতোমধ্যেই তার স্থান করে নিয়েছে ।
আরো পড়ুন,,,,,,
➡️ মানব সম্পদ উন্নয়নে ব্যবস্থাপনা কিভাবে ভূমিকা রাখে?
➡️ প্রত্যক্ষ সেবার ধরণ ও শ্রেণীবিভাগ ।
নিয়মিত পড়াশুনার সম্পর্কিত আপডেট পেতে ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেইজ ।