ব্যবস্থাপনা কার্যাবলী ব্যবস্থাপনার কাজ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য প্রদান করে। এটি ব্যবস্থাপনার উদ্দেশ্য, সমস্যা, সুযোগ-সুবিধা, স্থানীয়তা, সম্পর্ক ইত্যাদির সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য প্রদান করে।
একটি প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য অর্জনের জন্য একজন ব্যবস্থাপক যেসব কার্যাবলী সম্পাদন করে থাকেন তাকে ব্যবস্থাপনা কার্যাবলী বলে । প্রত্যেকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য থাকে । এবং একজন ব্যবস্থাপকের কাজ হল প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয় বস্তুগত ও অবস্তুগত উপাদানের সমন্বয় করে ব্যবস্থাপনা কার্যাবলীর উদ্দেশ্য অর্জন করা ।
ব্যবস্থাপনার কার্যাবলীটি চক্রাকারে ঘূর্ণায়মান হয় । ব্যবস্থাপনার বিশারদগণ ব্যবস্থাপনার এই কাজ বা কর্ম প্রক্রিয়াকে বিভিন্নভাবে বর্ণনা করেছেন যেমন :
ব্যবস্থাপনার জনক হেনরি ফেওলের মতে , ব্যবস্থাপনা কার্যাবলীর চক্র হলো : পূর্বানুমান বা পরিকল্পনা, সংগঠন, আদেশদান, সমন্বয়সাধন এবং নিয়ন্ত্রণ ।
আইরিক ও কুঞ্জ এর মতে, ব্যবস্থাপনার কার্যাবলী হলো: পরিকল্পনা, সংগঠন, কর্মী সংস্থান, নেতৃত্বদান এবং নিয়ন্ত্রণ।
হিকস ও গুল্লেট এর মতে, ব্যবস্থাপনার কার্যাবলী হল : সৃষ্টিকরন, পরিকল্পনা, সংগঠন, প্রেষণা, যোগাযোগ ও নিয়ন্ত্রণ ।
আরনেস্ট ডেল এর মতে, ব্যবস্থাপনার কার্যাবলী হলো : পরিকল্পনা, সংগঠন, কর্মীসস্থান, নির্দেশনা, নিয়ন্ত্রণ, উদ্ভাবন ও উপস্থাপন ।
অন্যদিকে এল. গুলিক ব্যবস্থাপনার কার্যাবলীকে POSTCORB নামে উপস্থাপন করেছেন ।
POSTCORB এর পূর্ণরূপ হল :
P = Planning,
O = Organizing,
S= Staffing,
D= Directing,
Co= Co-ordinating,
R=Reporting ,
B=Budgeting .
আমরা নিচে এলগুলিকে কার্যাবলী গুলোকে নিচে আলোচনা করতে পারি ।
ব্যবস্থাপনা কার্যাবলীর বিস্তারিত বর্ণনা
১. পরিকল্পনা ( Planning ) :
ভবিষ্যতে কি করা হবে তা আগাম ঠিক করাকে পরিকল্পনা বলে । ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়ার প্রথম কাজ হল পরিকল্পনা । এটি ব্যবস্থাপনার অন্যান্য কাজের ভিত্তিস্বরূপ । পরিকল্পপনা অনুযায়ী ব্যবস্থাপনার অন্যান্য কাজ ধারাবাহিকতা মেনে সম্পন্ন হয় । তাই পরিকল্পনা গ্রহণে ব্যবস্থাপকগনকে অত্যন্ত সতর্কতা হওয়ার প্রয়োজন পড়ে । শুধুমাত্র কি করা হবে তার সিদ্ধান্ত গ্রহণকে পরিকল্পনা হিসেবে না দেখে কখন এবং কোথায় করা হবে, কত সময়ের মধ্যে করতে হবে, কে বা কারা সম্পাদন করবে ইত্যাদি প্রয়োজনীয় সকল বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার প্রয়োজন পড়ে । তবেই তাই আদর্শ পরিকল্পনাই বিবেচিত হয় ।
২. সংগঠন ( Organizing )
গৃহীত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য উপকরণাদিকে সংঘটিত ও কাজে লাগানোর উপযোগী করাকেই সংগঠন বলে । ইট , বালি, সিমেন্ট, রড ইত্যাদি যখন আলাদা থাকে তখন তা কিছুই সৃষ্টি করতে পারে না । এই উপকরণগুলোকে যখন একত্রিত করে নির্মাণের কাজে লাগানো হয় তখন তার থেকে বিল্ডিং, সেতু ইত্যাদি নির্মিত হয় ।
মানুষগুলো যখন আলাদা আলাদা থাকে তখন তাদের দ্বারাও কিছু সৃষ্টি হয় না কিন্তু যখন কাজ ভাগ করে তা মানুষগুলোকে বুঝিয়ে দেওয়া হয় । দায়িত্ব ও ক্ষমতা নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়, একের সাথে অন্যের সম্পর্ক বলে দেয়া হয় তখন এই মানুষগুলো একটা সংগঠনে রুপায়িত ও কর্মক্ষম হয়ে উঠে ।
তাই উদ্দেশ্য অনুযায়ী কাজকে বিভাজন, প্রতিটা কাজের জন্য দায়িত্ব ও ক্ষমতা নির্দিষ্টকরণ এবং সে অনুযায়ী উপায়-উপকরণকে সংহত করে তাদের মধ্যে সম্পর্ক নির্দিষ্ট করার কাজকে সংগঠন বলা হয়ে থাকে ।
৩. কর্মীসংস্থান ( Staffing )
প্রতিষ্ঠানের জন্য যোগ্য ও দক্ষ কর্মী বাহিনী গড়ে তোলার লক্ষ্যে উপযুক্ত কর্মী সংগ্রহ, নির্বাচন, নিয়োগ ও উন্নয়নের কাজকে কর্মীসংস্থান বলে । সংগঠন প্রক্রিয়ায় কাজ এবং প্রতিটা কাজের দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব নির্ধারণের পর ওই কাজ সম্পাদনের জন্য যোগ্য জনবল সংস্থানের প্রয়োজন পড়ে । এই জনবলের যোগ্যতা, আগ্রহ ও আন্তরিকতার উপর প্রতিষ্ঠানের সাফল্য নির্ভর করে ।
তাই কর্মী নিয়োগে ভুল করলে প্রতিষ্ঠানকে দীর্ঘমেয়াদে তার কুফল ভোগ করতে হয় । গেটের জন্য যোগ্য নিরাপত্তা রক্ষীর প্রয়োজন । এক্ষেত্রে এই ধরনের কর্মীর উচ্চতা, বয়স, বুকের মাপ, সুস্থতা, পরিশ্রম করার ক্ষমতা, সাহস ইত্যাদি বিষয় দেখা প্রয়োজন ।
এক্ষেত্রে যদি দুর্বল ও রোগগ্রস্ত লোক নিয়োগ দেয়া হয় তবে তার নিকট থেকে উপযুক্ত সার্ভিস কখনোই প্রত্যাশা করা উচিত নয় তাই কোথায়, কোন মানের, কি সংখ্যক লোকের প্রয়োজন সে অনুযায়ী যোগ্য কর্মী নিয়েোগ করতে হয় ।
৪.নেতৃত্ব ও নেতৃত্বদান ( Leadership ):
কোন দল বা গোষ্ঠীর আচরণ ও কাজকে লক্ষ্যপানে এগিয়ে নেওয়ার কৌশলকে নেতৃত্ব বলে । যিনি বা যারা এরূপ প্রয়াস চালান তাকে বা তাদেরকে নেতা বলা হয়ে থাকে । নেতৃত্ব দানের বিষয়টি ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ । প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য আদেশ দেওয়া, পরিচালনা করা, প্রভাবিত করা, উৎসাহিত করা, দলগত প্রচেষ্টা জোরদার করা ইত্যাদি বিষয়ে এর সাথে সম্পৃক্ত ।
তাই ব্যবস্থাপনায় নির্দেশনা ,প্রেষণা ও সমন্বয় কাজ নেতৃত্বের অন্তর্ভুক্ত বলেই গণ্য হয় সেজন্য আমেরিকান বইগুলোতে ব্যবস্থাপনার কাজ উল্লেখ করতে যেয়ে পরিকল্পনা, সংগঠন, নেতৃত্বদান ও নিয়ন্ত্রণ এভাবে কাজের পরম্পরা উল্লেখ করা হয়ে থাকে ।
অবশ্য এখন অনেকে পরিকল্পনা, সংগঠন, কর্মী সংস্থান, নেতৃত্বদান ও নিয়ন্ত্রণ এই পাঁচটি কাজকে ব্যবস্থাপনার কাজ হিসেবে গণ্য করেন
৫. প্রেষণা (motivating)
অধস্থন কর্মীদের কাজের প্রতি অনুপ্রাণিত ও স্বেচ্ছাপ্রণোদিত করার কাজকে প্রেষণা বলে । কর্মীদের কোন কাজ করতে বললেই তারা সবসময় আন্তরিকতা নিয়ে সম্পাদন করবে এটা আশা করা যায় না । যন্ত্রপাতিসসহ অন্যান্য ব্যাক্তি বা উপকরণের সাথে জনশক্তির এখানেই বড় পার্থক্য বিরাজমান ।
জনশক্তি যদি কাজে স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বেচ্ছাপ্রণোদিত না হয় তবে তাদের যতই আদেশ – নির্দেশ প্রদান করা হোক, তত্ত্বাবধন করা হোক তা কখনোই কাঙ্খিত ফল দিতে পারেনা ।
ভীতি প্রদর্শন বা কাজের চাপ সৃষ্টি করলে স্বল্প সময়ের জন্য কখনো কিছুটা ভালো ফলাফল লক্ষ্য করা গেলেও বাস্তবে থাকা কার্যকর হয় না । তাই ব্যবস্থাপনার পক্ষ থেকে কর্মীদের উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করে কাজ আদায় এবং প্রতিষ্ঠানে ধরে রাখার কাজ বর্তমানকালে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । আর্থিক অনার্থিক বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনা দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে ।
৬. সমন্বয়সাধন (সমন্বয়কারী )
বিভিন্ন ব্যক্তি ও বিভাগের কাজকে একসূত্রে গ্রথিত ও সংযুক্ত করার কাজকে সমন্বয় বলে । একটা প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন ব্যক্তি ও বিভাগ কাজ করে । প্রতিটা ব্যক্তি ও বিভাগ যদি নিজেদের ইচ্ছেমতো কাজ করে অন্যের সাথে নিজের কাজের সমন্বয় বা সংযুক্তির বিষয়টি না ভাবে তবে দেখা যাবে একপর্যায়ে সামগ্রিক কাজে প্রচন্ড বিশৃঙ্খলা দেখা দিবে ।
তাই সম্মিলিত যে কোন কাজে সকল ব্যক্তি ও বিভাগকে প্রতিষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য অর্জনে বা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য অন্যের সাথে তাল মিলিয়ে চলার প্রয়োজন পড়ে । এটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের ।
উৎপাদন বিভাগ যদি ইচ্ছামতো উৎপাদন করে এবং বিক্রয় বিভাগ তার সাথে তাল মিলিয়ে বিক্রয় করতে ব্যর্থ হয় তবে এক পর্যায়ে পণ্য অবিক্রিত থাকবে এবং তা সকল ক্ষেত্রে মারাত্মক জটিলতার সৃষ্টি করবে ।
৫. নিয়ন্ত্রণ ( Controlling )
পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানের কাজ সম্পন্ন হয়েছে কিনা বা তার পরিমান বিচ্যুতি ঘটলে তার কারণ ও বিশ্লেষণ এবং প্রয়োজনীয় সংশোধনী ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ বলে ।
প্রতিষ্ঠানের যে কোন কাজ শুরুর পূর্বে পরিকল্পনা প্রণীত হয় তার আলোকে উপায় উপকরণাদিকে সংহত করা হয়ে থাকে । এরপর অধস্তনদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা ও প্রেষণা দেওয়া হয় ।
কার্য চলাকালে বিভিন্ন বিভাগের কাজে সমন্বয় সাধন করা হয় এরপর সময় শেষে পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ কতটা সম্পন্ন হয়েছে তা মূল্যায়নের প্রয়োজন পড়ে । এতে ব্যবস্থাপনা কার্য কতটা দক্ষতার সাথে পরিচালিত হয়েছে তার প্রমাণ মিলে ।
ধরা যাক , একটা প্রতিষ্ঠান তিন মাসে ১০,০০০ একক পণ্য উৎপাদন ও বিক্রয়ের পরিকল্পনা নিয়েছিল সেই অনুযায়ী ব্যবস্থাপনার অন্যান্য কাজ পরিচালিত হয় তিন মাস পর অবশ্যই দেখতে হবে যে কতটা ফল অর্জিত হয়েছে এবং বিচ্যুতি হলে কেন তা ঘটেছে যাতে পরবর্তী পরিকল্পনার মাধ্যমে সংশোধনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় এতে ব্যবস্থাপনার জবাবদিহিতা ও কার্যদক্ষতার মান বৃদ্ধি পায় ।
আশা করি বন্ধুরা আজকের ব্যবস্থাপনা কার্যাবলীর বিস্তারিত বর্ণনা ও ব্যাখা তোমাদের উপকারে আসবে । নিয়মিত পড়াশুনা সম্পর্কিত তথ্য পেতে যুক্ত থাকুন আমাদের সাথে ।
আরো পড়ুন :
➡️ব্যবস্থাপনার উদ্দেশ্য ও লক্ষসমূহ ।
➡️ব্যবস্থাপনা ও প্রশাসনের মধ্যকার পার্থক্য ।