সমীর শেখ কৃষক, আলী হোসেন কাপড়ের দোকানদার, সুমন দাস চালের ব্যবসায়ী, শান্তা সরকার চার করেন- এদের প্রত্যেকেই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত । কিন্তু সকলের কাজই ব্যবসায় নয় । সমীর যদি পরিবারের খাবারের প্রয়োজন মিটাতে চাল-ডাল, তরি-তরকারি উৎপন্ন করেন তবে তার এ অর্থনৈতি হয় । ব কাজটি ব্যবসায় হবে না । কিন্তু তিনি যদি বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে উৎপন্ন করেন এবং তা থেকে লাভের প্রত্যশা করেন। তবে তার কাজ ব্যবসায় হিসেবে গণ্য।
মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে আলী হোসেন কাপড় ও সুমন দাস চাল বি বিক্রয় করেন । ফলে তাদের দু’জনই ব্যবসায়ী। শান্তা সরকার চাকরি করেন । মাস গেলে নির্দিষ্ট মাইনে পান তিনি চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী নন । একইভাবে কাপড়ের বা চালের ব্যবসায়ী যদি চোরাই পণ্য কিনে বিক্রয় তবে তাদের কাজ বৈধ না হওয়ায় তাও ব্যবসায়ের পর্যায়ে পড়বে না ।
(ইংরেজি Business শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো, যে কোনো কাজে ব্যস্ত থাকা। কিন্তু বাংলায় এত ব্যাপক অর্থে ব্যবসায় শব্দটি ব্যবহৃত হয়নি। এখানে মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে উৎপাদন ও বণ্টনসহ সকল বৈধ অর্থনৈতিক কাজকে ব্যবসায় বলে । অর্থনৈতিক কাজ বলতে অর্থ উপার্জন বা আয়-রোজগারের উদ্দেশ্যে কোনে কাজ করাকে বুঝায় । কোনো কাজ অর্থনীতি সংশ্লিষ্ট হলেই তাকে ব্যবসায় বলা যায় না ।
ঐ কাজ করার পিছনে বি অবশ্যই মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্য যেমনি থাকতে হয় তেমনি তা আইনত বৈধ হওয়া আবশ্যক । ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে উৎপাদন সংক্রান্ত কাজ শিল্পের মাধ্যমে ও বণ্টন সংক্রান্ত কাজ বাণিজ্যের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। তাই মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে শিল্প, বাণিজ্য ও এর সহায়ক সকল কাজই ব্যবসায় ।
শিল্প রূপগত উপযোগ সৃষ্টি করে । এটি উৎপাদনের বাহন। শিল্পে উৎপাদিত পণ্য প্রকৃত ভোগকারী বা ব্যবহারকারীর নিকট বণ্টন বা নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে । শিল্পমালিক ও ভোক্তার মধ্যে এই বণ্টনের ক্ষেত্রে একাধিকবার পণ্যের মালিকানা হস্তান্তর বা ক্রয়-বিক্রয়ের প্রয়োজন হতে পারে । এক্ষেত্রে স্বত্ত্বগত বা ব্যক্তিগত উপযোগ সৃষ্টি হয় ।
এই ক্রয়-বিক্রয়ের কাজে ব্যাংক, বিমা, পরিবহণ, গুদামজাতকরণ, বিজ্ঞাপন ইত্যাদি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যথাক্রমে অর্থগত, ঝুঁকিগত, স্থানগত, কালগত ও জ্ঞানগত উপযোগ সৃষ্টি করে । তাই মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে উৎপাদন ও বণ্টন সংশ্লিষ্ট উল্লিখিত সকল কাজই ব্যবসায় হিসেবে গণ্য। তাই ব্যবসায় = মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে উৎপাদন + বণ্টন সংশ্লিষ্ট কাজের সমষ্টি ।
ব্যবসায়ের প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্য-Nature or Characteristics of Business
প্রকৃতি হলো কোনো বিষয়ের সাধারণ বৈশিষ্ট্য (General character) । অন্যদিকে বৈশিষ্ট্য হলো বিশেষভাবে নজরে পড়ে স্বতন্ত্রধর্মী এমন কিছু (Something especially noticeable)। প্রাচীনকাল থেকেই ব্যবসায় একটা স্বতন্ত্র পেশা বা অর্থনৈতিক কাজ হিসেবে পণ্য উৎপাদন ও বণ্টনের সাথে সম্পৃক্ত। তাই এর স্বতন্ত্র কিছু প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্য সহজেই অন্যান্য বৃত্তি থেকে একে ভিন্নতা দান করে। ব্যবসায়ের এরূপ প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্যসমূহ নিম্নে আলোচিত হলো:
১. মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্য (Expectation of profit) : ব্যবসায়ের প্রথম ও প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো-এর গঠন ও পরিচালনার পেছনে ব্যবসায়ীর মুনাফা অর্জনের প্রত্যাশা থাকে । আয় থেকে খরচ বাদ দিলে যা থাকে তাই মুনাফা । কম দামে কিনে বা কম খরচে উৎপাদন করে অধিক মূল্যে বিক্রয় পূর্বক মুনাফা অর্জনের প্রচেষ্টা ব্যবসায় হিসেবে গণ্য । কেউ নিজে ভোগের জন্য কিছু ক্রয় বা উৎপাদন করলে তা ব্যবসায় বিবেচিত হয় না । মা সন্তানের জন্য পোশাক তৈরি করলে তা ব্যবসায় নয় । কিন্তু মা মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে কাপড় কিনে পোশাক বানিয়ে বিক্রয় করলে তা ব্যবসায় ।
২. ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা (Risk and uncertainty) : ব্যবসায়ের সাথে ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা ওতপ্রোতভাবে জড়িত । ঝুঁকি হলো আর্থিক ক্ষতির সম্ভাবনা এবং অনিশ্চয়তা হলো প্রত্যাশিত সবকিছু ঘটবে এমন না হওয়ার অবস্থা । মুনাফা অর্জনের আশাতেই ব্যবসায়ী ক্ষতির ঝুঁকি বহন করে । তাই মুনাফাকে ঝুঁকি গ্রহণের পুরস্কার বলা হয় । বাজারে পণ্যের দাম কমে যেতে পারে এবং প্রাকৃতিক ও অপ্রাকৃতিক নানান বিপদ ক্ষতির কারণ হতে পারে । তাই এরূপ ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তার বোঝা মাথায় নিয়েই ব্যবসায়ীকে সবসময় পথ চলতে হয়। ব্যাংকে নির্দিষ্ট সুদে টাকা জমা রাখা ব্যবসায় নয় । কারণ এখানে কোনো ঝুঁকি নেই। কিন্তু কোথাও লাভ-ক্ষতির শর্তে অর্থ বিনিয়োগ করলে তা ব্যবসায়।
৩. লেনদেনের পৌনঃপুনিকতা (Recurring transaction) : লেনদেনের পৌনঃপুনিকতা বলতে বারে বারে কিনে ও বেচে মুনাফা অর্জনের প্রয়াস চালানোকে বুঝায় । ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে লেনদেন বারে বারে বা অব্যাহতভাবে সম্পাদিত হয়ে থাকে । একজন আসবাবপত্র বিক্রেতা নিয়মিতভাবেই ফরমায়েশমাফিক আসবাবপত্র তৈরি করে তা সরবরাহ করে । ফলে তার কাজ ব্যবসায় হিসেবে গণ্য।
কিন্তু কেউ যদি বাসার জন্য আসবাবপত্র কিনে তা পছন্দ না হওয়ায় বিক্রয় করে তবে তা ব্যবসায় হিসেবে গণ্য নয় । কৃষক চাষের জন্য গরু কিনে সুবিধাজনক না হওয়ায় তা বিক্রয় করে লাভ করেছে এটা ব্যবসায়ের মধ্যে পড়ে না । কিন্তু সে যদি গরু বারে বারে কেনে ও বিক্রয় করে তবে তা ব্যবসায় হিসেবে গণ্য হবে ।
৪. আইনগত বৈধতা (Legal validity) : আইনগত বৈধতা বলতে আইন অনুযায়ী কোনো কাজ অবৈধ না হওয়াকে বুঝায় । ব্যবসায় একটা বৈধ পেশা। তাই একে অবশ্যই আইনানুগ হতে হয়। ব্যবসায়ের অন্যান্য উপাদানের উপস্থিতি থাকার পরও যদি কেউ অবৈধ ও বেআইনী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে তবে তার কাজকে ব্যবসায় বলা যায় না ।
চোরাই পথে পণ্য এনে বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে কোনো ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান গঠন করা হলে সেখানে ব্যবসায়ের অন্যান্য উপাদান; যেমন- মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্য, ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা, লেনদেনের পৌনঃপুনিকতা ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য থাকলেও এর উদ্দেশ্যের বা কর্মকাণ্ডের আইনগত বৈধতা না থাকায় তা ব্যবসায় বলে বিবেচিত হতে পারে না।
৫. স্বাধীন পেশা বা বৃত্তি (Independant occupation) : স্বাধীন পেশা বলতে এমন পেশাকে বুঝায় যেখানে এর মালিক অন্যের অধীনে না থেকে নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়ে সকল কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে। ব্যবসায় সকল সমাজেই স্বাধীন পেশা বা উপজীবিকা হিসেবে গণ্য। একজন ব্যবসায়ী নিজস্ব চিন্তা-চেতনা অনুযায়ীব্যবসায় গঠন ও পরিচালনা করে। তার কাজে সে নিজেই সিদ্ধান্ত নেয় । এক্ষেত্রে সে অন্যের নির্দেশ ১ নয় ।
অংশীদারি ও অন্যক্ষেত্রে মালিকগণ যৌথভাবে সিদ্ধান্ত নেয়। তবে কোনো শেয়ারহোল্ডার যদি চাকরি করে তবে সেক্ষেত্রে ব্যবসায়ী বা বিনিয়োগকারী থেকে তার চাকরিকে আলাদা করে দেখা হয়। চা যেভাবে তার কাজ, পারিশ্রমিক, অফিস সময়, ছুটিসহ নানান কাজেই বাধ্যতামূলকভাবে অন্যের অধীন; কাজে বা বিনিয়োগকারী তা নয়।
৬. উপযোগ ও সম্পদ সৃষ্টি (Creation of utility and wealth) : সকল সমাজেই ব্যবসায় উপযোগ বিনি সৃষ্টির গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার (উপযোগ বলতে কোনো কিছুর অভাব পূরণের ক্ষমতাকে বুঝায় । ব্যবসায় তার যেে কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে নানান ধরনের উপযোগ সৃষ্টি করে মানুষের অভাব পূরণে সচেষ্ট থাকে । ব্যবসায়ের প্রধান শিল্পের মাধ্যমে পণ্যের রূপগত উপযোগ সৃষ্টি হয়।
কাঠ থেকে আসবাব পত্র, লৌহ আকরিক থেকে ইউ আবার ইস্পাত থেকে নানান যন্ত্রপাতি তৈরি- এভাবে প্রতিটা ক্ষেত্রে শিল্প নতুন নতুন উপযোগ সৃষ্টি করে। প্রতিটা ক্ষেত্রে নতুন মূল্য যোগ হয়। এতে সম্পদের মূল্যমান বাড়ে। বাণিজ্য তার বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের হা স্বত্বগত, অর্থগত, ঝুঁকিগত, স্থানগত, কালগত ও জ্ঞানগত উপযোগ সৃষ্টি করে। সুনাম ব্যবসায়ের ভূষ একবার প্রতিষ্ঠিত হলে তা ব্যবসায়ের বড় সম্পদ হিসেবে গণ্য হয় ।
আরো পড়ুন…………
➡️ মানব সম্পদ উন্নয়নে ব্যবস্থাপনা কিভাবে ভূমিকা রাখে?
➡️ প্রত্যক্ষ সেবার ধরণ ও শ্রেণীবিভাগ ।
নিয়মিত পড়াশুনার সম্পর্কিত আপডেট পেতে ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেইজ ।