চরিত্র রচনা
সূচনা : চরিত্রের মতো শ্রেষ্ঠ ও গৌরবজনক সম্পদ মানব জীবনে আর কিছুই নেই। অর্থ, ক্ষমতা, প্রতিপত্তি কোনো কিছুই এই সম্পদের কাছে দাঁড়াতে পারে না। অর্থ বা বিদ্যা অর্জনের ক্ষমতা ও সুযোগ সকলের সমান থাকে না। কিন্তু চরিত্র অর্জনের প্রচেষ্টা চালিয়ে সকলেই এই সম্পদের অধিকারী হতে পারে। আর যে ব্যক্তি চরিত্র নামের গৌরব মুকুট মস্তকে ধারণ করতে পারে সে যদি বিত্তহীন হয় তবুও সে সকলের শ্রদ্ধা ও সম্মানের পাত্র।
পৃথিবীর কোনো কিছুর কাছেই তাকে কখনো মাথা হেঁট করতে হয় না, বরং অন্য সবাই তার মহত্ত্ব ও শক্তির কাছে মাথা নত করে। চরিত্র এক প্রকার শক্তি। বিপুল অর্থ ব্যয় করে যা সম্ভব হয় না এই শক্তির সাহায্যে তা সহজেই সম্ভব হয়। চরিত্রবলে বলীয়ান হতে পারলে যে কোন অমঙ্গলের বিরুদ্ধে জয় অনিবার্য।
চরিত্রের স্বরূপ : চরিত্র শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে ‘চর’ (চলা) ধাতু থেকে। তাই এর মধ্যে আছে একটি গতির সংকেত। মানুষের যে জীবনযাপন প্রণালী তার মধ্য দিয়েই চরিত্রের প্রকাশ। মানুষের জীবনযাপন একটি গতিশীল ব্যাপার। এখানে মানুষকে তার অন্তর্নিহিত দুই শক্তি সৎ ও অসৎ প্রবৃত্তির সঙ্গে নিরন্তর লড়াই চালাতে হয়। এই লড়াইয়ে যদি সৎ প্রবৃত্তির জয় হয় তাহলে চরিত্রশক্তি অর্জিত হয়, আর বিপরীত প্রবৃত্তির জয় হলে চরিত্র বিধ্বস্ত হয়।
চরিত্র গঠন বলতে তাই বোঝায় এর গতি প্রবণতাকে সর্বদা আদর্শভিমুখী করার সাধনা। চরিত্রকে অনেকে কেবল নৈতিক অর্থে গ্রহণ করে থাকেন। কিন্তু তা সম্পূর্ণ সত্য নয়। চরিত্র শব্দটির অর্থ অনেক গভীর ও ব্যাপক। চরিত্র বলতে আসলে মানবিক সমন্বিতরূপ বোঝায়। মানুষের অন্তর্নিহিত বৃত্তিসমূহের বিকাশই চরিত্র।
ড. মুহম্মদ এনামুল হকের সিদ্ধান্ত, “বাক্য, কার্যে এবং চিন্তায় সামঞ্জস্য রাখিতে হইলে মানুষের মধ্যে যে একটি পবিত্র ভাব ফুটিয়ে উঠে তাকে চরিত্র বলিয়া অভিহিত করা যায়। তাহারই সাহায্যে মানুষ সত্য পথে, ন্যায় পথে, ধর্ম পথে অবিচলিত থাকিতে পারে। এই বিশেষ বিশেষ গুণ যাহার মধ্যে দেখিতে পাওয়া যায় তাহাকেই আমরা চরিত্রবান আখ্যা দিয়া থাকি।”
চরিত্র গঠনের উপায়ঃ প্রেম-প্রীতি, স্নেহ-মমতা, সহানুভূতি প্রভৃতি মানব হৃদয়ের স্বাভাবিক গুণ। এইসব গুণাবলির সম্যক বিকাশ লাভই চরিত্র গঠন। জীবনে আদর্শের প্রতি নিষ্ঠা ও প্রবল অনুরাগই চরিত্র গঠনের প্রথম ও প্রধান সোপান। পারিবারিক সুশিক্ষা, সৎ সংসর্গ, আদর্শবান শিক্ষা ও গুরুজনের উপদেশ এই সোপানকে প্রশস্ত করে।
স্মরণ রাখতে হবে, যাঁরা চরিত্রবান ও সাধু তাঁদের সংসর্গে থাকা বা উপদেশ শোনাই শিক্ষা নয়। প্রকৃত শিক্ষা হলো তাঁদের গুণাবলি অনুসরণ করে নিজের জীবন গঠন করা। অন্যের আদর্শকে যদি নিজের জীবনে প্রয়োগ করা না হয় তাহলে কেবল তা শুনে ও বলে কোনো লাভ নেই। এই জন্যই মিসেস রুজভেল্ট বলেছেন,”চরিত্র গঠনের কাজ শিশুকাল হতে মরণের আগ পর্যন্ত চলতে থাকে।”
চরিত্র গঠনে মাতা-পিতা ও অন্যের ভূমিকা : চরিত্র গঠনের ক্ষেত্রে পিতা-মাতা ও পরিবেশ উভয়ের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। শৈশবে মানব সন্তান অন্যকে নকল করতে চায়। যে বা যারা তার সবচেয়ে কাছের মানুষ শিশু তাকেই অনুসরণ করতে চায়। পরিবারে পিতা-মাতা, বড় ভাই-বোন তার সবচেয়ে কাছের মানুষ। এক্ষেত্রে এরাই শিশুর উপর গভীর প্রভাব রাখে।
তাই পিতা-মাতা, ভাই- বোন বা পরিবারের অন্যান্য আপন জনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য শিশুকে গোপনে গোপনে গড়ে তুলতে সাহায্য করে। অন্যদিকে পরিবেশও চরিত্র গঠনে অপরিসীম প্রভাব রাখে। মানুষের জীবন তো কেবল পরিবারের ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, তার আছে সামাজিক পরিবেশও। এই পরিবেশ যদি দূষিত হয় তাহলে মানুষের চরিত্রও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কলুষিত হতে বাধ্য।
বিশেষ করে বাল্য থেকে কৈশোর বা প্রথম যৌবন এই সময়ে তরুণরা ঐ দূষণের বেশি শিকার হয়। মানুষের চরিত্রের মূল প্রবণতাগুলো এই সময়ে গড়ে ওঠে। যে-কারণে কিছু কিছু বদভ্যাস চেষ্টা করে দূর করা যায়। কিন্তু চারিত্রিক প্রবণতা দূর করা সুকঠিন, অনেক ক্ষেত্রে অসম্ভব। কেননা অভ্যাস বাইরের জিনিস, আর চরিত্র মানব মনের অনেক গভীর স্তরের ব্যাপার, আর তা গড়ে ওঠে তার জীবনের প্রথম পর্বে। এজন্য বাল্যকাল থেকেই চরিত্র গঠনের প্রতি মনোযোগী হওয়া দরকার। এজন্য বলা হয়—”A man is known by the company he keeps.”
চরিত্র হননের কারণ : চরিত্রহীন মানুষের সাথে পশুর তুলনা দেওয়া হয়। অর্থাৎ চরিত্রহীনতা ও পাশবিকতার মধ্যে কোনো প্রভেদ নেই। চরিত্রহানি ঘটে কোন কারণে? অধিকাংশক্ষেত্রেই দেখা গেছে, সঙ্গদোষ চরিত্র হননের অন্যতম প্রধান কারণ। মানুষে যাদের সাথে মেশে তাদের দ্বারা অতি সহজে প্রভাবিত হয়।
ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব এক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাছাড়া, নৈতিক জ্ঞানের অভাব এক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। নীতিজ্ঞান মানবজীবনের শ্রেষ্ঠ পাথেয়, নীতিহীনতা চরিত্রহীনতারই নামান্তর। আমাদের সমাজে আজ দুর্নীতি যেভাবে তার সর্বগ্রাসী ভয়াল থাবা বিস্তার করেছে, এখানে চারিত্রিক দৃঢ়তা বজায় রাখা দুরূহ ব্যাপার।
যে সমাজে সততার নাম বোকামি, যেখানে রাজনীতির বিকল্প শব্দ সন্ত্রাস সেখানে ব্যক্তিচরিত্রের উৎকর্ষতা ধরে রাখা খুবই কষ্টসাধ্য বিষয় । রাষ্ট্রই এখন ব্যক্তির চরিত্র হনন করছে, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ইদানীং চরিত্রহীনতাকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। সুতরাং চরিত্রহননের অনেক পথ খোলা, মানুষকে অধঃপাতে নেমে যাওয়ার হাজারটা সুযোগ অবারিত।
চরিত্র গঠনের আবশ্যকতা : ইংরেজিতে একটি কথা আছে—Character is destiny -অর্থাৎ চরিত্রই নিয়তি। মানুষের ভাগ্য পূর্বনির্ধারিত নয়, সে নিয়তির হাতের পুতুলও নয়। ভাগ্য গড়ার ক্ষমতা আছে তারই নিজের মধ্যে।
সে ইচ্ছা করলে সৌভাগ্যের অধিকারি হতে পারে, আবার দুর্ভাগ্যের নর্দমায়ও ডুবতে পারে। এটি সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে তার চরিত্র গঠনের উপর। মানুষ যদি সচ্চরিত্রের অধিকারি হয় তাহলে সৌভাগ্যের গৌরব মুকুট তার মস্তকে শোভা পাবে, আর যদি চরিত্রহীনতা তাকে কলুষিত করে তাহলে দুর্ভাগ্যের পঙ্ককুণ্ডে নিমজ্জিত হবে।
সেই নরক থেকে মুক্তি পাওয়া অত্যন্ত কঠিন। এজন্য বলা হয়ে থাকে যে, অর্থ বিনষ্ট হলে তা আবার অর্জন করা যায়, এমনকি স্বাস্থ্যহানি ঘটলেও তা পুনরুদ্ধার করা যায় কিন্তু চরিত্র যদি একবার নষ্ট হয় তবে তা ফিরে পাওয়া যায় না। আর চরিত্র হারানো মানে জীবন নিঃস্ব হয়ে যাওয়া। এতে জীবনের মূল উদ্দেশ্যই বিনষ্ট হয়।
উপসংহারঃ চরিত্রের বিকাশ সাধনই মানব জীবনের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। এই সাধনায় কেবল ব্যক্তিই যে লাভবান হবে তা নয়, ব্যক্তিচরিত্র গঠনের মধ্য দিয়েই গড়ে ওঠে জাতীয় চরিত্র। তাই ব্যক্তির সঙ্গে সঙ্গে জাতিও তাতে উন্নত হবে। আর প্রত্যেক জাতিই যদি চরিত্র গঠনের ব্যাপারে সচেতন হয় তাহলে এই মাটির পৃথিবীতেই একদিন স্বর্গ নেমে আসবে।
আরো পড়ুন :
➡️মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাঃ রচনা ।
নিয়মিত এডুকেশন সম্পর্কিত তথ্য পেতে যুক্ত থাকুন আমাদের ফেইসবুক পেইজের সাথে ।